Posts

শেষ রিকশা

--- 🖋️ গল্পের নাম: "শেষ রিকশা"   ✍️ লেখক:নয়ন তারা    🌇 গল্প শুরু— ঢাকা শহর। একটানা ট্রাফিক জ্যাম আর ধুলোবালি মেশানো বাতাসের শহর। কিন্তু এই শহরেই ছড়িয়ে আছে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন যুদ্ধ।   আজ সকাল থেকেই বৃষ্টি পড়ছে।  অগোছালো ছাতা মাথায়, ভিজে স্যান্ডেল পরে নীলা বাসার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।  হাসপাতালের বিল পরিশোধ করতে হবে আজ।  বাবা ICU-তে, আর হাতে আছে মাত্র তিন হাজার টাকা।   নীলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্রী।  মা নেই, ছোট ভাই ক্লাস সেভেনে পড়ে।  বাবার রিকশা চালিয়ে যা আয় হতো, তা দিয়েই চলছিল তাদের সংসার। কিন্তু হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে বাবার অবস্থা খারাপ হয়ে গেল।   সকাল সাতটায় নীলা বের হলো একটি কাগজের খামে কিছু কাগজ ও বাকি টাকাগুলো নিয়ে।  ছাতা ভেঙে গেছে আগেই, রিকশাও নেই কোথাও। হেঁটেই রওনা দিলো বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। রাস্তার মোড়ে এসে হঠাৎ একটা রিকশা থামল।  এক বৃদ্ধ রিকশাওয়ালা। — "কই যাবেন মা?" —              "বঙ্গবন্ধু মেডিকেল।  কিন্তু আমার...

নারী নিরাপত্তা ও রাজনীতি

📘 গল্পের নাম: "সেদিন বাসে ওঠা হয়নি মেয়েটার" ---  (১) ভোর পাঁচটা। কলকাতা স্টেশন। একটা অন্ধকার প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে এক তরুণী, নাম তিথি। পরনে হলুদ সালোয়ার, হাতে একটা পুরনো ব্যাগ। সে চাকরির খোঁজে বর্ধমান থেকে এসেছে—একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে ইন্টারভিউ আছে। মা বলেছিল, “ফিরে এস মা, শহরে মানুষ ভালো না।” কিন্তু সংসারের অভাব কি শহরের ভয় বোঝে? তিথির পাশেই দাঁড়িয়ে আরেকজন তরুণ—নাম রুদ্র। চোখে চশমা, কিন্তু চোখদুটো ভীষণ সজাগ। সে লক্ষ্য করে, মেয়েটা একটু অসহায়, কিন্তু মুখে সাহস। বাসে ওঠার সময় তিথি আচমকা বলে উঠল, “ভাই, আপনি একটু পাশে বসবেন? আমি বাইরে থেকে আসছি... একটু ভয় করছে।” রুদ্র মাথা নেড়ে বলল, “চলুন।” এই সাধারণ কথায় যে একটা ঝড় শুরু হবে, কেউ জানত না। ---   (২) বাস ছাড়ল। তিথির গন্তব্য ছিল সেক্টর ফাইভ। রুদ্রও যাচ্ছিল অফিসে। কথায় কথায় জানা গেল দু’জনের জীবনের কষ্ট—বেকারত্ব, অভাব, কিন্তু দুজনেই লড়ে যাচ্ছে। তিথি জানাল, বাবার মৃত্যু আর ভাইয়ের স্কুল ফি নিয়ে তার চিন্তা। রুদ্র বলল, “সাহস রাখুন, আপনি পারবেন।” সেই একটা বাক্য তিথির মনে গেঁথে গেল। বাস যখন এজেন্সি মোড় পার হচ্ছিল, ...

সামাজিক অবক্ষয়ের বাস্তব চিত্র

গল্পের নাম: “আলোর খোঁজে এক শহর”    ১. শহরটার নাম ছিল সন্ধ্যাবাঁশি। ছোট একটা শহর। বর্ধমান আর বীরভূমের মাঝামাঝি একটা জায়গায়, যেখানে লাল মাটি, তালগাছ, আর সন্ধ্যাবেলা হালকা কুয়াশা শহরটাকে এক অভিমানী কাব্যিকতায় মুড়ে রাখে। সন্ধ্যাবাঁশির মানুষগুলো একসময় বড় গর্ব করত—এই শহরের স্কুল থেকে বেরিয়ে কেউ ডাক্তার হয়েছে, কেউ সিভিল সার্ভিসে, কেউ বিদেশে পড়তে গেছে। পাড়ার মোড়ে চায়ের দোকানে তখনও সন্ধ্যেবেলায় রাজনৈতিক আলোচনা, কিশোরদের ক্রিকেট ম্যাচ আর প্রৌঢ়দের তর্ক-বিতর্ক চলত নিয়মমাফিক। কিন্তু সময় বদলেছে ।   ২. নবনীতা আর সন্ধ্যাবাঁশির স্কুল নবনীতা ম্যাম ছিলেন শহরের স্কুলের ইতিহাস শিক্ষিকা। একসময় ওঁর ক্লাস মানেই ছাত্রদের ভিড়। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের গল্প হোক বা ফরাসি বিপ্লব—তিনি এমনভাবে বলতেন, যেন ছাত্ররা বইয়ের ভেতর ঢুকে পড়ে। স্কুল ছিল ওঁর প্রাণ। ছাত্ররা ছিল সন্তানের মতো। কিন্তু গত কয়েক বছরে শহরের স্কুলটায় বদল এসেছে। এখন শিক্ষকের চেয়ে মিড-ডে মিল নিয়ে আলোচনা বেশি হয়। প্রধান শিক্ষক হরিদেব বাবুকে কয়েক মাস আগেই দেখা গেছে পঞ্চায়েত প্রধানের সঙ্গে রাতের অন্ধকারে কিছু কাগজে সই কর...

"যখন শিক্ষকতা রাজনীতির বলি হল: সত্যের পথ কি বন্ধ হয়"

গল্পের নাম: "চিঠি আসে না আর"    ১. বর্ধমান জেলার এক নিভৃত গ্রামের নাম দেউলিয়া। নামটা শুনে কেউ কেউ হাসে। কেউ ভাবে, এমন নামও হয়! তবে গ্রামের মানুষের জীবনে সেই নামটাই সত্যি হয়ে উঠেছে—দেউলিয়া, অর্থনীতিতেও, আশায়ও। গ্রামের একমাত্র উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক অনিরুদ্ধবাবু প্রায়শই বলেন, “আমরা আসলে এক দেউলিয়া স্বপ্নের বাসিন্দা।” অনিরুদ্ধবাবু ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান শিক্ষক। দল-রাজনীতি থেকে দূরে থেকেও রাজনৈতিক যন্ত্রণায় আক্রান্ত। সাত বছর ধরে শিক্ষকতা করেও হঠাৎ করেই জানতে পারলেন, তার চাকরি বাতিল হয়েছে। “নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ত্রুটি”—এই ছিল সংক্ষিপ্ত চিঠির ভাষ্য।  ২. বিধানসভা ভোটের দামামা বেজেছে। গ্রামের মোড়ে মোড়ে লাউডস্পিকারে গান বাজছে—“দিদি আছেন, থাকবেন, থাকতেই হবে।” আরেক পাশে—“দিদি আর ভাইপোকে এবার ঘরে পাঠান।” চা দোকানে রাজনীতি নিয়ে উত্তপ্ত আলোচনা। — “সব চোর! দল যাই হোক, খায় সবাই।” — “না না, আগে যা ছিল, এখন অনেক ভালো।” — “তুই বুঝিস না! অনিরুদ্ধ স্যার কি কোনোদিন টাকা দিয়ে চাকরি পেয়েছিলেন?” বাচ্চা ছেলেরা পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, একজন বলে উঠল, “স্যার আর পড়াতে আসেন না কেন?” ...

যেখানে মেধা হারায় রাস্তার ধুলোয়

গল্পের নামঃ "কালো কাঁচের দোকান"    ১ কাঞ্চন রায় — পঁইত্রিশ বছর বয়স, এম.এ পাশ। দক্ষিণ কলকাতার এক পুরনো পাড়ায় ভাড়া বাড়িতে স্ত্রী সুলেখা ও একমাত্র মেয়ে খুকির সঙ্গে দিন কাটে তার। একসময় স্কুলে গেস্ট টিচার ছিলেন, তবে সরকারি চাকরির আশায় কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়ে দিনের পর দিন পরিশ্রম করতেন। কপালে আজও কিছু জোটেনি। আজ সকালেও একই। দোকানে বসে বসে মোবাইলে চোখ রাখছে। বাজারে তার ছোট্ট একটা দোকান—প্লাস্টিক চামচ, টিফিনবক্স, আর কিছু সস্তা চায়না গয়না বিক্রি করে। দোকানের নাম দিয়েছিল — “কালো কাঁচের দোকান”। কাঁচের জানালা নেই, কিন্তু স্বপ্নগুলো এখন কাঁচের মতো ভঙ্গুর।    ২ লোকজন এখন আর আগের মতো বাজারে আসে না। অনলাইন শপিং, বেহাল অর্থনীতি, বেকারত্ব, আর রাজনীতির খেলা – এই সব মিলিয়ে বাজার যেন অদৃশ্য ভাঙচুরে ভরা। হাটে আগের মতো ভিড় নেই, হাসি নেই। দোকানদাররা একে অপরকে দেখে কাঁধ ঝাঁকে। দোকানে বসে বসে কাঞ্চন ভাবে, “আমি কী করলাম জীবনে? ক্লাস এইটে খুকি পড়ে। ওর জন্যও তো একটা ভবিষ্যৎ চাই...” সেই সময় একটা লোক ঢোকে দোকানে—পাঞ্জাবি পরা, সোনালী চেইন গলায়। — "এই যে ভাই, পলিথিন আছে?" — "না দাদা...

অতীতের পত্র

গল্পের নাম: “অতীতের পত্র”    (১ম ব্লক: সূচনা)  শান্তিনিকেতনের নির্জন একটি কোণে দাঁড়িয়ে ছিল এক পুরনো লাল ইঁটের বাংলো। জায়গাটার নাম ছিল "চিত্রা নীড়"। কেয়া নামের এক তরুণী, সদ্য গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে কলকাতা থেকে এখানে এসেছিল, শান্তির খোঁজে। কিন্তু সে জানত না, এই শান্তিনিকেতনে তার জীবন বদলে যাবে চিরতরে।    (২য় ব্লক: পাণ্ডুলিপির আবিষ্কার)  প্রথম দিন বিকেলে সে যখন পুরনো বইপত্র গোছাচ্ছিল, একটা কাঠের বাক্সে আবিষ্কার করল হলুদ হয়ে যাওয়া কিছু চিঠি। প্রেরক: "অরিন্দম", প্রাপক: "মীরা"। চিঠিগুলোতে ভালোবাসা, বেদনা, প্রতীক্ষা—সবকিছু যেন প্রাণ পেত কাগজে কাগজে। এক জায়গায় লেখা ছিল: "তুমি না এলে এই জীবন এক শূন্য বাক্য হয়ে থাকবে, মীরা। তোমার অপেক্ষায় আমি প্রতিটি পূর্ণিমায় এই জানালায় বসে থাকি…"    (৩য় ব্লক: অরিন্দম কে? মীরা কে?)  চিঠিগুলো পড়তে পড়তে কেয়া যেন হারিয়ে গেল অন্য এক জগতে। সে ঠিক করল, এই চিঠিগুলোর রহস্য খুঁজে বের করবেই। স্থানীয় এক বৃদ্ধ, নাম ‘রঘুনাথ কাকা’, তাকে বলল, “এই বাংলো একসময় কবি অরিন্দম সেনের ছিল। প্রেমে পড়েছিলেন তাঁর ছাত্রীর সঙ্গে, মীরা নাম ছিল...

প্রাক্তন স্যারের শ্রেণিকক্ষ

গল্প: "প্রাক্তন স্যারের শ্রেণিকক্ষ" ---   ১. ভাঙনের শুরু    ২০১৮ সালের এপ্রিল মাস। তখন অর্ক মুখুজ্জে চেয়ারে বসে প্রথমদিনের পাঠ পরিকল্পনা করছিল। মাত্র কিছুদিন আগেই নিয়োগপত্র হাতে পেয়েছিল—পশ্চিমবঙ্গ স্কুল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে চূড়ান্ত পরীক্ষা দিয়ে যোগ্যতার ভিত্তিতে নির্বাচিত হয়। সাত বছরের স্বপ্ন, পরিশ্রম, হাহাকার—সবকিছুর শেষে মায়ের চোখের জল, বাবার গর্বিত মুখ আর আত্মবিশ্বাসী ছাত্রদের হাসি, সব মিলিয়ে যেন জীবনের শ্রেষ্ঠ সকাল। কিন্তু কে জানত, ঠিক সাত বছর পর, সেই সকালটাই হবে জীবনের সবচেয়ে অন্ধকার দিন! ২০২5 সালের এপ্রিল। সুপ্রিমকোর্টের রায়ে বাতিল হল পুরো প্যানেল। কাগজে ছাপা হল—“অবৈধ নিয়োগ, ২০১৬ SSC বাতিল, 26000 শিক্ষক চাকরি হারালেন।” অর্কর নামও ছিল সেই তালিকায়। ---   ২. বাতিল হওয়া এক পরিচয়    চাকরি হারানোর পর অর্ক যেন হারিয়ে গেল এক ধোঁয়াশার অরণ্যে। স্কুলের সদর দরজা, স্টাফ রুম, ক্লাসরুম—সব যেন হঠাৎ অচেনা হয়ে উঠল। একদিন অফিস থেকে ফোন এল—“স্যার, আপনার কিছু কাগজ রয়ে গেছে। পাস বুক, অভ্যন্তরীণ ফাইল… এসে নিয়ে যান।” হাতে কাগজ ধরেই তার...