যেখানে মেধা হারায় রাস্তার ধুলোয়
গল্পের নামঃ "কালো কাঁচের দোকান"
১
কাঞ্চন রায় — পঁইত্রিশ বছর বয়স, এম.এ পাশ। দক্ষিণ কলকাতার এক পুরনো পাড়ায় ভাড়া বাড়িতে স্ত্রী সুলেখা ও একমাত্র মেয়ে খুকির সঙ্গে দিন কাটে তার। একসময় স্কুলে গেস্ট টিচার ছিলেন, তবে সরকারি চাকরির আশায় কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়ে দিনের পর দিন পরিশ্রম করতেন। কপালে আজও কিছু জোটেনি।
আজ সকালেও একই।
দোকানে বসে বসে মোবাইলে চোখ রাখছে। বাজারে তার ছোট্ট একটা দোকান—প্লাস্টিক চামচ, টিফিনবক্স, আর কিছু সস্তা চায়না গয়না বিক্রি করে। দোকানের নাম দিয়েছিল — “কালো কাঁচের দোকান”। কাঁচের জানালা নেই, কিন্তু স্বপ্নগুলো এখন কাঁচের মতো ভঙ্গুর।
২
লোকজন এখন আর আগের মতো বাজারে আসে না। অনলাইন শপিং, বেহাল অর্থনীতি, বেকারত্ব, আর রাজনীতির খেলা – এই সব মিলিয়ে বাজার যেন অদৃশ্য ভাঙচুরে ভরা। হাটে আগের মতো ভিড় নেই, হাসি নেই। দোকানদাররা একে অপরকে দেখে কাঁধ ঝাঁকে।
দোকানে বসে বসে কাঞ্চন ভাবে,
“আমি কী করলাম জীবনে? ক্লাস এইটে খুকি পড়ে। ওর জন্যও তো একটা ভবিষ্যৎ চাই...”
সেই সময় একটা লোক ঢোকে দোকানে—পাঞ্জাবি পরা, সোনালী চেইন গলায়।
— "এই যে ভাই, পলিথিন আছে?"
— "না দাদা, নিষেধ। এখন পেপার ব্যাগই বিক্রি করি।"
লোকটা চোখ রাঙিয়ে বলে,
— "তাহলে ব্যবসা করছ কীভাবে? সরকারি লোক চেক করতে এলেই তো হাঁসফাঁস করবে!"
৩
কাঞ্চন চুপ করে থাকে। সে জানে, এই লোকটা হয়তো কারো ঘনিষ্ঠ—নেতার লোক। পাড়ার দোকানগুলিতে গত কিছুদিন ধরে চাঁদা তোলার চাপ, দলীয় পতাকা টাঙানো নিয়ে জ্বালাতন, বাজারের মধ্যে পার্টির মাইক বাজানো, এসব চলছেই। প্রতিবাদ করলে দোকান বন্ধ করে দেবে।
দুপুরে কাঞ্চন পাশের চায়ের দোকানে বসে।
চা-ওয়ালা বিজন বলে,
— “আজ সকালে বাজার কমিটির মিটিং ছিল। নতুন কমিটি হলো। তবে তোর দোকানের জায়গাটা নিয়ে ঝামেলা আছে।”
— “কেন? আমি তো ৮ বছর ধরে এইখানে বসি!”
— “বলে কি! এখন নাকি জায়গা নেবে হীরা দার ভাইপো। নেতার লোক, চুপ থাকাই ভালো।”
৪
কাঞ্চন মাথা নিচু করে চলে আসে।
ঘরে ফিরে সুলেখা বলে,
— “রাতের চাল নেই কাঞ্চন। আজ বোধহয় অল্প তেলে তাড়ি দিতে হবে।”
খুকি পাশে বসে মায়ের আঁচল ধরে।
— “বাবা, তুমি আবার শিক্ষকতা করো না কেন?”
— “চাকরি নেই মা। স্কুলে এখন পার্টির লোক ছাড়া কিছু হয় না।”
খুকি চুপ করে, হয়তো কিছু বোঝে না।
কাঞ্চন রাতভর ঘুমাতে পারে না। চোখে ভেসে ওঠে একসময় সে পশ্চিমবঙ্গ স্কুল সার্ভিস কমিশনে আবেদন করেছিল। ইন্টারভিউ দিয়েছিল, মেধা তালিকাতেও ছিল।
তবে একদিন খবর এলো—
“আপনার নাম বাতিল হয়েছে। প্রমাণ নেই, সুপারিশ নেই।”
৫
পরদিন সকালে কাঞ্চন দোকানে যায়, দেখে সামনে তাজা সাদা রং করে নতুন একটা সাইনবোর্ড টাঙানো হচ্ছে।
“শ্রী হীরা এন্টারপ্রাইজ”
তাকিয়ে দেখে, দোকানের অর্ধেকটা দখল করা।
সে প্রতিবাদ করে,
— “এটা আমার জায়গা!”
কেউ শোনে না। পুলিশ ডেকে লাভ হয় না।
পুলিশ বলে,
— “কাগজ দেখান।”
— “আমার তো শুধু বাজার কমিটির রসিদ ছিল…”
— “তাহলে কিচ্ছু করতে পারবো না।”
৬
সন্ধ্যায় কাঞ্চন হঠাৎ বাজারে একটা টেবিল নিয়ে এসে দাঁড়ায়।
টেবিলের উপর একটা বোর্ড —
“সত্যিকারের শিক্ষা কোথায় হারালো?”
নীচে সে নিজের সার্টিফিকেটগুলো সাজিয়ে রাখে—M.A, B.Ed, CTET, SSC admit card, এমনকি সেই বাতিল হওয়া ইন্টারভিউ লিস্টের স্ক্রিনশট।
লোকে ভিড় করে দেখে।
কেউ বলে,
— “ভাইরে! এত পড়াশুনা করে বাজারে বসো?”
— “কি আর করবেন, রাজনীতির খেলা। নিজের লোক ছাড়া কিছু হয় না।” — “এগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় দেন না কেন?”
একজন তরুণ ছেলেও ছবি তোলে, ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করে হ্যাশট্যাগ দিয়ে—
#RealTalentIgnored #WestBengalReality #BengalNeedsChange
৭
দুদিনের মধ্যে সেই পোস্ট ভাইরাল হয়। কাঞ্চনের দোকানে মিডিয়ার লোক আসে, ইন্টারভিউ নেয়।
লোকজন এসে তার হাত ধরে। কেউ কেউ টাকা দিয়ে যায়। এক NGO বলে,
— “আপনি আমাদের স্কুলে অতিথি শিক্ষক হতে পারেন।”
আরও অনেকে বলে—
— “আপনার প্রতিবাদ আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে।”
৮
কাঞ্চনের দোকান আবার ফেরে। এবার নামটা বদলে—
“শিক্ষিত স্বপ্ন”
এখানে শুধু জিনিসপত্র নয়, কাঞ্চন এখন বিক্রি করে আত্মবিশ্বাস।
সে ছোট ছোট টিউশন শুরু করে, মোবাইলে ‘এক্সাম টিপস’ ভিডিও দেয়, মেয়ের সঙ্গে পড়াশোনা করে।
রাজনীতি এখনও চারপাশে, কিন্তু সে জানে —
“আমি যদি মাথা নত না করি, কেউ আমাকে মুছে ফেলতে পারবে না।”
---
শেষ কথা
এই গল্প হয়তো এক কাঞ্চনের গল্প, কিন্তু বাস্তবে এরকম হাজার হাজার কাঞ্চন আজ বাজারে বসে জীবন চালাচ্ছে। তারা শুধু চাকরি চায় না, তারা সম্মান চায়।
আপনি যদি এই কাহিনি পড়ে কাঁটা দিয়ে ওঠেন, তাহলে এটা শুধু একটা গল্প নয় —
এটা পশ্চিমবাংলার বর্তমান বাজারের আয়না।
---
আপনার মতামত জানাতে কমেন্ট করুন। গল্পটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন আপনার বন্ধুদের সঙ্গে।
#বেকার_বাংলা #রাজনীতি_ও_চাকরি #শিক্ষিত_স্বপ্ন
---
[শেষ]
---
*নয়ন তারা*
Comments
Post a Comment