"যখন শিক্ষকতা রাজনীতির বলি হল: সত্যের পথ কি বন্ধ হয়"

গল্পের নাম: "চিঠি আসে না আর"  


 ১. বর্ধমান জেলার এক নিভৃত গ্রামের নাম দেউলিয়া। নামটা শুনে কেউ কেউ হাসে। কেউ ভাবে, এমন নামও হয়! তবে গ্রামের মানুষের জীবনে সেই নামটাই সত্যি হয়ে উঠেছে—দেউলিয়া, অর্থনীতিতেও, আশায়ও। গ্রামের একমাত্র উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক অনিরুদ্ধবাবু প্রায়শই বলেন, “আমরা আসলে এক দেউলিয়া স্বপ্নের বাসিন্দা।” অনিরুদ্ধবাবু ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান শিক্ষক। দল-রাজনীতি থেকে দূরে থেকেও রাজনৈতিক যন্ত্রণায় আক্রান্ত। সাত বছর ধরে শিক্ষকতা করেও হঠাৎ করেই জানতে পারলেন, তার চাকরি বাতিল হয়েছে। “নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ত্রুটি”—এই ছিল সংক্ষিপ্ত চিঠির ভাষ্য।

 ২. বিধানসভা ভোটের দামামা বেজেছে। গ্রামের মোড়ে মোড়ে লাউডস্পিকারে গান বাজছে—“দিদি আছেন, থাকবেন, থাকতেই হবে।” আরেক পাশে—“দিদি আর ভাইপোকে এবার ঘরে পাঠান।” চা দোকানে রাজনীতি নিয়ে উত্তপ্ত আলোচনা। — “সব চোর! দল যাই হোক, খায় সবাই।” — “না না, আগে যা ছিল, এখন অনেক ভালো।” — “তুই বুঝিস না! অনিরুদ্ধ স্যার কি কোনোদিন টাকা দিয়ে চাকরি পেয়েছিলেন?” বাচ্চা ছেলেরা পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, একজন বলে উঠল, “স্যার আর পড়াতে আসেন না কেন?” দোকানি হাসে, “স্যাররে চাকরি খেয়ে ফেলছে সরকার।”


 ৩. অনিরুদ্ধবাবু বাড়ির এক কোণে বসে পুরনো ছাত্রদের চিঠিগুলো পড়েন। কেউ কেউ আমেরিকায়, কেউ ব্যাঙ্কে চাকরি করে, কেউ-বা পাড়ারই স্কুলে। প্রায় সবাই তাকে লিখেছে—“স্যার, আপনি না থাকলে আমি পড়তেই পারতাম না।” এখন আর কেউ চিঠি লেখে না। হোয়াটসঅ্যাপের যুগে চিঠিরা হারিয়ে গেছে। কিন্তু অনিরুদ্ধবাবুর কাছে এই চিঠিগুলোই স্মৃতি, সম্মান ও সহানুভূতির দলিল। চাকরি যাওয়ার পর তিনি আদালতের দ্বারস্থ হন। কোর্ট কবে রায় দেবে কেউ জানে না। তিনি জানেন, নতুন কোনো চাকরি পাবেন না। দল ছিল না, পেছনে নেতা ছিল না, অর্থ ছিল না। ছিলেন শুধু একজন শিক্ষক।


 ৪. গ্রামে রাজনৈতিক সভা বসেছে। বড় বড় গাড়িতে নেতারা এসেছে। বাচ্চাদের চকোলেট, মহিলাদের শাড়ি আর পুরুষদের একটা করে মোবাইল হাতে ধরিয়ে ছবি তোলা হচ্ছে। কেউ একজন বলে, “স্যার থাকলে এসব নিতে দিতেন না।” অন্যজন উত্তর দেয়, “স্যার ভোটে দাঁড়ালেই না হয় নিতাম! নেতা না হলে কে শোনে?” সেই রাতে অনিরুদ্ধবাবু ডায়েরিতে লিখলেন— > “আমি নেতা নই, কিন্তু শিক্ষক। আমার হাতেই হাজার জন তৈরি হয়েছে। আজ আমি বাতিল। আমার ছাত্ররা জানে না, আমি কাঁদি। জানে না, আমি প্রতিদিন আত্মহত্যার কথা ভাবি। কিন্তু আমার প্রাক্তন ছাত্ররা এখন অফিসার, কেউ এমএলএ-র প্রাইভেট সেক্রেটারি। তারা কেউ আমার চাকরি ফেরাতে পারে না।”  


 ৫. নতুন শিক্ষক এসে গেছে স্কুলে। সে যুব পদ্মমূলের নেতা। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে সে পোস্ট পেয়েছে। ক্লাসে ঢুকে সে প্রথমেই বলে, “এই স্কুল এখন আমাদের দখলে।” ছাত্ররা চমকে যায়। অনিরুদ্ধবাবুর কথা তারা ভুলতে পারে না। তারা তার মত আচরণ চায়, তার মত আদর্শ খোঁজে। কিন্তু এখন আদর্শ নয়, ক্ষমতা জরুরি। একদিন সন্ধ্যায় একদল ছাত্র আসে অনিরুদ্ধবাবুর কাছে। — “স্যার, আপনি আমাদের একটা গ্রুপে পড়ান, আমরা স্কুলে যাব না।” তিনি চুপ করে থাকেন। তারপর মৃদু হেসে বলেন, — “পড়া বন্ধ করা যাবে না। কিন্তু হ্যাঁ, আমি আবার পড়াতে শুরু করব।”  


 ৬. পড়ানো আবার শুরু হয়। ঘরের এক কোণে, বিনা পয়সায়, শুধু ভালোবাসা দিয়ে। ধীরে ধীরে ছাত্রদের ভিড় বাড়ে। কেউ কেউ ডানপন্থী দলের লোক পাঠিয়ে হুমকি দেয়, “আপনি অবৈধ কোচিং করছেন।” তিনি বলেন, “আমি শিক্ষক। কেউ এ কথা প্রমাণ করুক যে আমি টাকা নিচ্ছি।” মামলা হয় না। কারণ ছাত্ররা ভিডিও করে রাখে, পোস্ট করে ফেসবুকে—“আমাদের প্রকৃত শিক্ষক।” ভিডিও ভাইরাল হয়। পত্রিকা আসে সাক্ষাৎকার নিতে। রাজ্যের বিরোধী দল তাকে “জনগণের শিক্ষক” বলে সম্মানিত করে। সরকার বিব্রত বোধ করে। জেলা শিক্ষা আধিকারিক চিঠি পাঠান—“আপনার বিষয়ে নতুন করে বিবেচনা করা হচ্ছে।”  


 ৭. নির্বাচনের দিন আসে। গ্রামে অশান্তি। দাঙ্গা হয়। বুথ দখল হয়। এক বৃদ্ধ ভোটার বলে, “ভোট তো দিতে পারিনি, শুধু কালি লাগিয়ে দিল।” অনিরুদ্ধবাবু ভোট দিতে যান। দেখে, কেন্দ্র দখল হয়ে গেছে। বলেন, “আমি প্রতিবাদ জানাই।” পুলিশ বলে, “স্যার, চুপ করে থাকুন। সমস্যা হবে।” তিনি চুপ থাকেন না। সোজা আদালতে মামলা করেন। মিডিয়ায় খবর হয়—“প্রাক্তন শিক্ষক ভোটাধিকার নিয়ে আইনি লড়াইয়ে।”


 ৮. মাস কয়েক পরে আদালত রায় দেয়—“চাকরি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ।” অনিরুদ্ধবাবুর চাকরি ফেরে। স্কুলে ফিরে আসেন, ছাত্ররা মিষ্টি খাওয়ায়। নতুন শিক্ষক বদলি হন। পড়ার নতুন জোয়ার আসে। নতুন প্রজন্ম তার কাছে শিখে—নীতি, সততা ও সংগ্রাম।
 শেষ ডায়েরির পাতায় লেখেন তিনি— > “আমি ফিরে এসেছি। ফিরে এসেছে শিক্ষকতা। ফিরে এসেছে সত্য। কিন্তু আমার হাজার সহকর্মী এখনো লড়াই করছেন। আমার এই জয় একার নয়, এই লড়াই চলবে। কারণ সত্যকে সময়ের অপেক্ষা করতে হয়, কিন্তু সে ফিরে আসে।"
---

 উপসংহার: এই গল্পটি একটি সাধারণ শিক্ষকের চোখে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংকট, দলীয় প্রভাব, দুর্নীতি এবং সৎ মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি।




গল্পটি ভালো লাগলে নিচে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন।  



*নয়ন তারা*

Comments

Popular posts from this blog

প্রাক্তন স্যারের শ্রেণিকক্ষ

ছায়া থেকে আলো

ডি এ পাওয়ার অপেক্ষা