প্রাক্তন স্যারের শ্রেণিকক্ষ
গল্প: "প্রাক্তন স্যারের শ্রেণিকক্ষ"
---
১. ভাঙনের শুরু
২০১৮ সালের এপ্রিল মাস। তখন অর্ক মুখুজ্জে চেয়ারে বসে প্রথমদিনের পাঠ পরিকল্পনা করছিল। মাত্র কিছুদিন আগেই নিয়োগপত্র হাতে পেয়েছিল—পশ্চিমবঙ্গ স্কুল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে চূড়ান্ত পরীক্ষা দিয়ে যোগ্যতার ভিত্তিতে নির্বাচিত হয়। সাত বছরের স্বপ্ন, পরিশ্রম, হাহাকার—সবকিছুর শেষে মায়ের চোখের জল, বাবার গর্বিত মুখ আর আত্মবিশ্বাসী ছাত্রদের হাসি, সব মিলিয়ে যেন জীবনের শ্রেষ্ঠ সকাল।
কিন্তু কে জানত, ঠিক সাত বছর পর, সেই সকালটাই হবে জীবনের সবচেয়ে অন্ধকার দিন!
২০২5 সালের এপ্রিল। সুপ্রিমকোর্টের রায়ে বাতিল হল পুরো প্যানেল। কাগজে ছাপা হল—“অবৈধ নিয়োগ, ২০১৬ SSC বাতিল, 26000 শিক্ষক চাকরি হারালেন।” অর্কর নামও ছিল সেই তালিকায়।
---
২. বাতিল হওয়া এক পরিচয়
চাকরি হারানোর পর অর্ক যেন হারিয়ে গেল এক ধোঁয়াশার অরণ্যে। স্কুলের সদর দরজা, স্টাফ রুম, ক্লাসরুম—সব যেন হঠাৎ অচেনা হয়ে উঠল। একদিন অফিস থেকে ফোন এল—“স্যার, আপনার কিছু কাগজ রয়ে গেছে। পাস বুক, অভ্যন্তরীণ ফাইল… এসে নিয়ে যান।”
হাতে কাগজ ধরেই তার বুক ধক করে উঠেছিল। স্কুলে যাওয়া! যে স্কুল তার অস্তিত্ব, সেই জায়গায় সে আজ ‘প্রাক্তন’ হয়ে ফিরে যাবে?
---
৩. ফেরা, এক অদ্ভুত যন্ত্রণা
সকালে তাড়াতাড়ি উঠেই অর্ক জামা কাপড় পরে বেরিয়ে পড়ল। যাত্রাপথে বাসের জানালায় তাকিয়ে ভাবছিল—এই পথে সে কতদিন এসেছে! কত বাচ্চা প্রতিদিন "সুপ্রভাত স্যার" বলে চিৎকার করেছে! অথচ আজ, মনে হচ্ছে যেন সে আসছে এক শোকবার্তা বহন করে।
স্কুলের গেটের কাছে এসে দাঁড়াতেই দেখল, নতুন দারোয়ান। অচেনা চোখে তাকাল।
“আপনার পরিচয়?”
অর্ক কাঁপা গলায় বলল, “আমি... অর্ক মুখুজ্জে। ইংরেজি শিক্ষক ছিলাম। ২০১৮ থেকে...”
“ও... বাতিল প্যানেলের?”
এই ‘বাতিল’ শব্দটা যেন ঘুষি মেরে বসে বুকের মাঝখানে। সে চুপ করে মাথা হেঁট করে ভিতরে ঢুকে পড়ল।
---
৪. অচেনা অফিসরুমের চেনা গন্ধ
অফিসরুমে ঢুকে কাগজ চাইল। নতুন ক্লার্ক বলল, “স্যার আপনি একটু বসুন, খুঁজে দেখি।”
অর্ক চোখ মেলে তাকাল। অফিসরুম তো একই আছে—কিন্তু টেবিল, খাতাপত্র, মানুষের মুখ—সব নতুন।
টেবিলের এক কোণে আজও ঝুলছে পুরনো সাফল্যের কাচ ফ্রেমে বাঁধানো ছবি—সেখানে সে ছিল, ছাত্রদের নিয়ে জিতেছিল "জেলা স্তরের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নাটক" পুরস্কার।
আজ সেই ছবি যেন মুখ ঘুরিয়ে নিল।
---
৫. অচেনা চেয়ার, পরিচিত ব্যথা
স্টাফ রুমে ঢুকতেই চমকে উঠল। যে চেয়ারে সে সাত বছর বসে ছাত্রদের প্রশ্নপত্র বানিয়েছে, সে চেয়ারে এখন নতুন কেউ।
“স্যার আপনি?” — একজন নতুন শিক্ষক অবাক হয়ে বললেন।
অর্ক হেসে বলল, “হ্যাঁ, কিছু কাগজ আনতে এলাম।”
চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখল—এক কোণে রাখা টিফিন টেবিলে আজ আর তার জলপাই রঙের ব্যাগ নেই।
তবু এক কোণে আজও পড়ে আছে তার হাতের লেখা—“বই পড়া অভ্যাস নয়, আত্মার খোরাক।”
কেউ ফেলে দেয়নি। হয়তো কেউ পড়েও না। কিন্তু থেকে গেছে, নিঃশব্দে।
---
৬. ক্লাসরুম, যার দরজা আজ বন্ধ
অর্ক পা বাড়াল তার ক্লাসরুমের দিকে—সেকশন B, ক্লাস সেভেন। দরজার কাঁচ দিয়ে ভেতরে উঁকি দিল।
নতুন একজন শিক্ষক ব্ল্যাকবোর্ডে লিখছেন—"Narration change"।
ছাত্ররা চুপ করে শুনছে, কেউ কেউ অমনোযোগী।
এই ক্লাসেই সে একদিন “The Road Not Taken” পড়িয়েছিল নাট্যাভিনয়ের মাধ্যমে। সব ছাত্র তন্ময় হয়ে শুনেছিল—
“Two roads diverged in a yellow wood…”
আজ সেই ক্লাসরুমে সে নেই। ছাত্ররাও যেন ভুলে গেছে।
হঠাৎ করিডোরে একজন চিৎকার করে উঠল—“অর্ক স্যার?”
পিছন ফিরে দেখল—রনি, ক্লাস এইট-এর ছাত্র ছিল।
“স্যার, আপনাকে দেখি না কেন?”
অর্ক মাথা নিচু করে বলল, “আসতে পারি না আর। চাকরি নেই তো রে।”
রনির চোখ ছলছল। “স্যার, আমরা আজও আপনি শেখানো গান গাই। ওদের মতো কেউ শেখাতে পারে না।”
---
৭. বিদায়ের দিন নয়, ভালোবাসার শুরু
বেরিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ কয়েকজন ছোট ছাত্র দৌড়ে এল।
“স্যার! পুজোর নাটক করবেন তো না?”
“স্যার, আপনার গল্প বলাটা মিস করি!”
“স্যার, আপনি তো বলতেন—শিক্ষক মানেই নেতা, বন্ধু, বাবা…”
অর্ক আর কথা বলতে পারল না। কাঁপতে থাকা গলায় শুধু বলল,
“তোমরা ভুলো না, আমি আজীবন তোমাদের স্যারই থাকব।”
---
৮. ঘরে ফেরা, স্মৃতির সাথে
বাড়ি ফিরে অর্ক তার আলমারি খুলে পুরনো সবকিছু বের করল—ছাত্রদের হাতে লেখা চিঠি, উপহার, আঁকা ছবি, ছাত্রদের লেখা ‘স্যার আমার হিরো’, সরস্বতী পুজোর নাটকের স্ক্রিপ্ট, ক্লাস পরীক্ষার প্রশ্নপত্র।
এই সাত বছরে সে যেটুকু সৃষ্টি করেছে—তা কোনও আদালত বাতিল করতে পারে না।
সে জানে, তার শিক্ষকতা শেষ হয়নি—শেষ হয়েছে কেবল একটি অধ্যায়।
---
৯. একটি শিক্ষক, একটি সময়, একটি ইতিহাস
সরকার বদলাতে পারে, ফাইল ছিঁড়ে ফেলতে পারে, চাকরি কেড়ে নিতে পারে। কিন্তু একজন সত্যিকারের শিক্ষক কোনো কাগজে বাঁধা থাকেন না।
তার শিক্ষা থাকে ছাত্রদের মনে। তার গলা থাকে শ্রবণে। তার হাত থাকে হাতেখড়ির আঙুলে।
অর্ক হয়ত আজ আর ক্লাসে পড়ায় না, কিন্তু তার ছাত্ররা আজও তার শেখানো 'মানুষ' হওয়ার শিক্ষা বয়ে নিয়ে চলে।
---
শেষ কথা
ক্লাসরুমের বাইরে দাঁড়িয়ে অর্ক চোখ বন্ধ করে ভাবল—“এখনও কি ঘণ্টা বাজছে?”
হ্যাঁ। মনে মনে শোনা যায়—
“টান…টান…টান…শেষ ঘণ্টা নয়। নতুন শুরু।”
---
[এই গল্পটি আপনাদের জন্য উৎসর্গ করা, যাঁরা শিক্ষকতা শুধু চাকরি নয়—একটা সাধনা বলে মনে করেন।]
---
গল্পটি ভালো লাগলে নিচে অবশ্যই কমেন্ট করে জানান।
* নয়ন তারা*
This comment has been removed by the author.
ReplyDelete