সামাজিক অবক্ষয়ের বাস্তব চিত্র

গল্পের নাম: “আলোর খোঁজে এক শহর”  


 ১. শহরটার নাম ছিল সন্ধ্যাবাঁশি। ছোট একটা শহর। বর্ধমান আর বীরভূমের মাঝামাঝি একটা জায়গায়, যেখানে লাল মাটি, তালগাছ, আর সন্ধ্যাবেলা হালকা কুয়াশা শহরটাকে এক অভিমানী কাব্যিকতায় মুড়ে রাখে। সন্ধ্যাবাঁশির মানুষগুলো একসময় বড় গর্ব করত—এই শহরের স্কুল থেকে বেরিয়ে কেউ ডাক্তার হয়েছে, কেউ সিভিল সার্ভিসে, কেউ বিদেশে পড়তে গেছে। পাড়ার মোড়ে চায়ের দোকানে তখনও সন্ধ্যেবেলায় রাজনৈতিক আলোচনা, কিশোরদের ক্রিকেট ম্যাচ আর প্রৌঢ়দের তর্ক-বিতর্ক চলত নিয়মমাফিক। কিন্তু সময় বদলেছে । 


 ২. নবনীতা আর সন্ধ্যাবাঁশির স্কুল নবনীতা ম্যাম ছিলেন শহরের স্কুলের ইতিহাস শিক্ষিকা। একসময় ওঁর ক্লাস মানেই ছাত্রদের ভিড়। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের গল্প হোক বা ফরাসি বিপ্লব—তিনি এমনভাবে বলতেন, যেন ছাত্ররা বইয়ের ভেতর ঢুকে পড়ে। স্কুল ছিল ওঁর প্রাণ। ছাত্ররা ছিল সন্তানের মতো। কিন্তু গত কয়েক বছরে শহরের স্কুলটায় বদল এসেছে। এখন শিক্ষকের চেয়ে মিড-ডে মিল নিয়ে আলোচনা বেশি হয়। প্রধান শিক্ষক হরিদেব বাবুকে কয়েক মাস আগেই দেখা গেছে পঞ্চায়েত প্রধানের সঙ্গে রাতের অন্ধকারে কিছু কাগজে সই করতে। পরে জানা গেছে, মিড-ডে মিলের চাল, ডাল চুরি হয়েছে। ছাত্ররা খালি পেটে ক্লাসে বসে। নবনীতা কিছু বললেই—“তুমি বেশি বোঝো না ,” এই বলে উড়িয়ে দেয় হরিদেব বাবু।


 ৩. রাজনীতি ঢুকে পড়েছে ক্লাসরুমে আগে শহরে যারা ক্লাব করত, তারা পুজো আর রক্তদান শিবিরে সীমাবদ্ধ ছিল। এখন সেই ক্লাবগুলো 'তপশিলি উন্নয়ন প্রকল্প', 'ইউথ ভিশন স্কিম'—এইসব নামের আড়ালে লক্ষ লক্ষ টাকার প্রকল্প চালায়। ক্লাবের ছেলেরা এখন বাইক চড়ে ঘোরে, হাতে সোনার চেন, গায়ে শার্ট খুলে হাঁটে। একদিন নবনীতা ক্লাসে দেখেন, দশম শ্রেণির ছাত্র রাহুলের হাতে মোবাইল। বললেন, “স্কুলে মোবাইল আনা বারণ, তুমি জানো তো?” রাহুল চোখে চোখ রেখে বলে, “আমার দাদার নাম জানেন তো? ক্লাব প্রেসিডেন্ট। বলবেন তো?” নবনীতা অবাক। এক সময় যে ছেলেরা 'ম্যাম' বলেই সামনে দাঁড়াত, তারা এখন ক্ষমতার নাম করে ভয় দেখায়। ক্লাসরুমের মধ্যেও রাজনীতি ঢুকে গেছে।  


 ৪. সন্ধ্যাবাঁশি পাড়া আর ধর্মের দেয়াল এক সময় এই শহরে দুর্গাপুজোতে মুসলিমরা চাঁদা দিত, আর ইদের সময় হিন্দুরা 'সোয়ানিয়া হালুয়া' খেতে যেত গাফ্ফার কাকার বাড়ি। এখন সে সব গল্প বইয়ের পাতায় আটকে গেছে। হঠাৎ একদিন শহরে গুজব ছড়ায়—একটি নির্দিষ্ট ধর্মের লোকজন সরকারি প্লট দখল করে নিচ্ছে। কেউ প্রমাণ চায় না, কিন্তু চারপাশে ফিসফাস শুরু হয়। রাজনৈতিক নেতারা আসেন, বলেন, “আমরা সব জেনেছি। ব্যবস্থা নিচ্ছি।” এরপর শহরের বাজারে দুই ধর্মের কিশোরদের মধ্যে হাতাহাতি, কিছু দোকানে ভাঙচুর, রাতে থানার সামনে ধর্ণা। গাফ্ফার কাকার ছেলে হাসিব, যে নবনীতাদের ছাত্র ছিল, কলেজে ইতিহাস পড়ছিল—সেই রাতে চায়ের দোকানের সামনে ল্যাম্পপোস্টে ঝুলে পাওয়া যায়। পুলিশ বলে, “আত্মহত্যা।” শহর জানে, হাসিব আত্মহত্যা করেনি।  


 ৫. সত্যের পাশে দাঁড়ানোর খেসারত নবনীতা আর থাকতে পারেন না। একদিন এক সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেন—স্কুলে কীভাবে মিড-ডে মিলে দুর্নীতি হচ্ছে, ছাত্রদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে, স্কুলে রাজনীতি ঢুকে পড়েছে। পরদিনই তাঁর বিরুদ্ধে এক অভিযোগ দায়ের হয়—“এক ছাত্রকে মানসিক হেনস্থা করেছেন।” স্থানীয় প্রশাসন তদন্তের নাম করে ওঁকে সাসপেন্ড করে। কেউ পাশে দাঁড়ায় না। সহকর্মীরা মুখ ঘোরায়। তিনি স্কুলে আর ফিরতে পারেননি।  


 ৬. শহরের নতুন বাস্তবতা আজ সন্ধ্যাবাঁশিতে বইয়ের দোকানগুলো কমে গেছে। মোবাইল রিপেয়ার আর লটারির দোকান বেড়েছে। লাইব্রেরি বন্ধ। পার্কে আগে যেখানে শিশুরা খেলত, এখন সেখানে রাজনৈতিক মিটিং হয়। যে শহর একসময় গর্ব করত তার সংস্কৃতি নিয়ে, সে এখন গর্ব করে কার পোস্ট ভাইরাল হলো, কার দল থেকে টেন্ডার এল, কে নতুন মোটরবাইক কিনল—এসব নিয়ে।  


 ৭. আশার আলো: একটি ছোট্ট স্কুল তবুও শহরের প্রান্তে, পুরনো পোস্ট অফিসের পাশের একটা ছোট্ট ঘরে নবনীতা একটা “সন্ধ্যা পাঠশালা” চালান। নাম দিয়েছেন—"আলোর খোঁজে"। সেখানে এখন ২০-২৫টা বাচ্চা আসে। কেউ ভবঘুরে মায়ের সন্তান, কেউ কিশোর ছিনতাইকারী ছিল, কেউ বস্তির ছেলে। নবনীতা ওদের আবার বইয়ের সঙ্গে পরিচয় করান—রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, হোমার, মার্ক টোয়েন। একদিন এক ছাত্র বলে, “দিদিমণি, আমি বড় হয়ে সাংবাদিক হব। সত্যটা সবাইকে দেখাব।” নবনীতা একটু হেসে বলেন, “তুমি পারবে, কারণ তুমি ভয় পাও না।”


 ৮. শেষ কথা: সন্ধ্যাবাঁশি আবার আলো দেখতে চায় সন্ধ্যাবাঁশির আকাশ এখনও নীল। মাঠে এখনও কুয়াশা নামে। মানুষজন এখনও প্রাণে বাঁচতে চায়। সমাজের অবক্ষয় তাকে আঁকড়ে ধরলেও, কিছু কিছু মানুষ রোজ জেগে ওঠে নতুন আশায়, নতুন লড়াইয়ে। তারা বিশ্বাস করে—সত্যকে চাপা দেওয়া যায়, কিন্তু থামানো যায় না। নবনীতাদের মতো মানুষই সেই আশার নাম।
--- 



 গল্পটি ভালো লাগলে নিচে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন। 



 *নয়ন তারা*

Comments

Popular posts from this blog

প্রাক্তন স্যারের শ্রেণিকক্ষ

ছায়া থেকে আলো

ডি এ পাওয়ার অপেক্ষা