এক জীবনের যন্ত্রণা ও অনুপ্রেরণার কাহিনী

--- শিক্ষকের নাম বরুণ কুমার দাস:  




এক জীবনের যন্ত্রণা ও অনুপ্রেরণার কাহিনি পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুর জেলার ছোট্ট এক জনপদ, কাশিপুর। এখানেই জন্মগ্রহণ করেন বরুণ কুমার দাস। একটি স্বচ্ছল ও শিক্ষিত পরিবারে তাঁর বেড়ে ওঠা। পিতা ছিলেন এলাকার এক নামকরা স্কুলের প্রধান শিক্ষক আর মাতা পোস্ট অফিসের পোস্টমাস্টার। পরিবারের শিক্ষাগত পরিবেশ এবং আদর্শে বড় হয়ে উঠেছিলেন বরুণ এবং তাঁর বড় ভাই। শৈশব থেকেই মেধাবী, পরিশ্রমী ও সাদাসিধে স্বভাবের ছিলেন তিনি। মাত্র ২২ বছর বয়সে, স্নাতক পাশ করার পর তিনি একজন স্কুল শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন একটি সরকারি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। নতুন চাকরি, নতুন স্বপ্ন, নতুন দায়িত্ব—সবকিছুই যেন এক নতুন রঙিন অধ্যায়ের সূচনা ছিল তাঁর জীবনে। কিন্তু সমস্যা ছিল স্কুলের দূরত্ব। স্কুলটি তাঁর বাড়ি থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ছিল। প্রতিদিন যাতায়াত ছিল খুবই কষ্টকর। এই সময়েই তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। স্ত্রী ছিলেন বুদ্ধিমতী ও সহানুভূতিশীল, তবে স্বামীকে প্রতিদিন এতটা দূরত্বে যাওয়া-আসা করতে দেখে তিনিও উদ্বিগ্ন ছিলেন। পরিবার, স্ত্রী, এবং বাবা-মার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা তাঁর পক্ষে ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠেছিল। দিনের পর দিন চলতে থাকে এই দ্বন্দ্ব—একদিকে সংসার, আরেকদিকে শিক্ষকতা, আর মাঝখানে তাঁর নিজের জীবন। তবুও, বরুণ দাস ছিলেন অনন্য এক চরিত্র। কঠিন পরিস্থিতিকেও সহজ করে নিতে জানতেন। মুখে সর্বদা হাসি লেগে থাকত, কোনদিন তাঁর মুখে দুঃখের ছায়া দেখা যেত না। তিনি বিশ্বাস করতেন, জীবন যেমনই হোক, মন থেকে শান্ত থাকাই আসল। সেদিক থেকে তিনি ছিলেন একদম বিন্দাস। একদিন হঠাৎ করেই তিনি বিদ্যালয়ের টিচার ইনচার্জ হিসেবে নিযুক্ত হন। সঙ্গে সঙ্গেই দায়িত্বের পরিমাণ বাড়ে। তারপর
একসময় তিনি হন ‘হেড অব দ্যা ইনস্টিটিউশন’। শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়—নতুন লড়াই, নতুন যুদ্ধ। এই নতুন দায়িত্বে এসে বরুণ কুমার দাস বুঝতে পারেন, স্কুল চালানো শুধুমাত্র পড়ানো নয়—এর সঙ্গে রয়েছে প্রশাসনিক দায়িত্ব, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সমস্যার সমাধান, ছাত্রদের ভবিষ্যৎ চিন্তা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, এবং আরও অনেক কিছু। চাপ বেড়েই চলছিল, আর সেই সঙ্গে বাড়ছিল বয়স। চুল পাকা শুরু করল, শরীরে ক্লান্তির ছাপ পড়তে লাগল। তবুও, বরুণ দাস কখনো হার মানেননি। তাঁর কাছে বিদ্যালয় ছিল একটি বড় পরিবার, আর ছাত্রছাত্রীরা ছিলেন তাঁর সন্তানের মতো। শত কষ্ট, শত দায়িত্বের মাঝেও তিনি সযত্নে পরিচালনা করতেন বিদ্যালয়টিকে। সময় গড়িয়ে চলল। একদিন এক প্রাক্তন ছাত্র এসে তাঁর পায়ে হাত রেখে বলল, "স্যার, আপনি না থাকলে আমি আজ এখানে পৌঁছাতাম না।" বরুণ কুমার দাসের চোখে জল এসে গেল। তিনি বুঝলেন, তাঁর জীবনের সমস্ত পরিশ্রম ব্যর্থ নয়। তিনি ছিলেন একজন সাধারণ মানুষ, কিন্তু তাঁর মতো শিক্ষকেরা সমাজের ভিত্তি তৈরি করেন। তাঁর কাহিনি আমাদের শেখায়, জীবনে চাপ থাকবেই, বাধা আসবেই, কিন্তু যদি মন থেকে ভালোবাসা থাকে—তাহলে সব কিছুই সম্ভব। বরুণ কুমার দাসের জীবন এক অনুপ্রেরণা, এক শিক্ষক হৃদয়ের গল্প, যাঁর আত্মত্যাগে শত শত ছাত্র কে আলোকিত করে চলেছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। ---







*নয়ন তারা*

Comments

Popular posts from this blog

প্রাক্তন স্যারের শ্রেণিকক্ষ

ছায়া থেকে আলো

ডি এ পাওয়ার অপেক্ষা