কাঠ মানির কাব্য

 



🕰️' সময় সেবার' আড়ালে কাঠ মানির কাব্য.....

১.

শ্রাবণের এক ভেজা বিকেল। বাঁকুড়া জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রাম - রাণীবাঁধ। কাঁচা রাস্তা, কাদামাখা পথ, মাটির বাড়ি আর সেই পুরনো বটগাছটা — যেটার ছায়ায় বসেই পঞ্চায়েত সদস্য সুধাংশুবাবু আজকাল 'সময় সেবা কেন্দ্র' চালান।

তার পাশে বাঁশের মাচায় বসে দুধে-চা বানাচ্ছেন লীলাবউ। দু’পাশে ছেলেমেয়েরা বসে অঙ্ক কষছে। সময় সেবা কেন্দ্র মানে স্থানীয় যুব দলের একটি ‘সামাজিক উদ্যোগ’, যেখানে ‘জনসেবা’ নাম করে চায়ের আড্ডা, ডোনেশনের গল্প আর কখনো-কখনো কিছু রাজনৈতিক ছক কষা হয়।

সুধাংশুবাবু সদ্যই জেলার শাসকদলের ব্লক কো-অর্ডিনেটর হয়েছেন। তিনি জনগণের সেবা করতে চান — অন্তত বলার সময় সেটাই বলেন।

কিন্তু তার ‘সেবার’ পেছনে আছে অন্য গল্প।


২.

দু’মাস আগেই গ্রামে এসেছিল এক NGO — ‘নবজাগরণ’। তারা বলেছিল, শিক্ষার জন্যে বিনামূল্যে ট্যাব দেওয়া হবে গ্রামের ছাত্রছাত্রীদের। চুক্তি অনুযায়ী, স্থানীয় সময় সেবা কেন্দ্রই সেই ট্যাব বিলি করবে।

সেইখানেই শুরু কারসাজি।

২৫০টি ট্যাব আসার কথা ছিল — এল মাত্র ১৭৫টি। বাকি ৭৫টি বাজারে বেচে দিল সুধাংশুবাবুর দল। প্রতি ট্যাবে লাভ ৫ হাজার টাকা।

পরে যা হল তা আরও ভয়াবহ। সেই লাভের টাকা দিয়েই করা হল যুব সংগঠনের এক “উন্নয়ন শিবির” — যেখানে প্যান্ডেল, খাওয়া-দাওয়া, মঞ্চ, ঢাক-ঢোল — সব ছিল। যেন উৎসব। এবং ওই দিনই ঘোষণা করা হল — “সময় সেবা কেন্দ্র” এখন আরও বড় রূপ পাবে, ব্লকে ৪টি নতুন শাখা খোলা হবে।

লোকজন মুগ্ধ। কে বলবে যে এই সেবার পেছনে লুকিয়ে আছে একটা সুপরিকল্পিত কমিশন বাণিজ্য!


৩.

গল্পে ঢুকে পড়ে এক নতুন চরিত্র — তৃষা দে। কলকাতা থেকে সদ্য IAS পাশ করা। জেলাতে নতুন পোস্টিং পেয়েছেন। অল্প বয়স, সাহসী মেয়ে।

গ্রামে পরিদর্শনে এসে সে লক্ষ্য করলেন কিছু ট্যাব বিলি হয়েছে, কিছু হয়নি। তালিকা চাইলেন, বিলি হওয়া ছাত্রদের নাম চাইলেন। শুরু হল গরমিলের খেলা।

কেউ বলে তার ছেলে পেয়েছে, কেউ বলে লিস্টে নাম ছিল, কিন্তু ট্যাব পায়নি। কয়েকটি ছাত্র বলল, তাদের থেকে ভোটার কার্ড, ছবি সব নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু পরে কিছুই মেলেনি।

তৃষা দে বুঝলেন কিছু একটা গোলমাল আছে।


৪.

তারপরেই শুরু তদন্ত। BDO-কে সঙ্গে নিয়ে হঠাৎ হানা পড়ল সময় সেবা কেন্দ্রে। ফাইলে কিছুই নেই, খাতা ভরা প্রচার আর ছবি — কিন্তু রসিদ নেই, কোনো অফিসিয়াল বিলি লিস্ট নেই।

সুধাংশুবাবু প্রথমে বললেন, "আমরা তো শুধুই সমাজসেবা করি, দিদির কথা মত কাজ করি।"

কিন্তু ছবি আর ভিডিও ফুটেজে উঠে এল অন্য চিত্র — প্যান্ডেল পার্টির দিন কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যাওয়া ট্যাবের বাক্সগুলো, সেই বিক্রির কথোপকথন ফাঁস করল এক প্রাক্তন যুব সদস্য — দীপক।

সে জানাল, কীভাবে তাকে হুমকি দিয়ে দলের কাজ করানো হত, কীভাবে প্রতিটি প্রকল্পে কাটমানি বসত।


৫.

বিষয়টি মিডিয়ায় আসতেই শোরগোল পড়ে গেল। শাসকদল চাপ তৈরি করল তৃষা দে’র উপর — যেন তদন্ত বন্ধ হয়। এক রাতে তার কোয়ার্টারের বাইরে কিছু অচেনা মুখ দেখা গেল। ফোনে হুমকি এল, “আপনি আমাদের এলাকায় শান্তি নষ্ট করছেন, ফিরে যান কলকাতায়।”

কিন্তু তৃষা দে দমবার মেয়ে নন। তিনি FIR করলেন, নিজের নিরাপত্তা চাইলেন এবং তদন্তকে নিয়ে গেলেন জেলার উচ্চপদস্থ দপ্তরে।

এক মাসের মধ্যে বেরিয়ে এল আরও ৫টি প্রকল্প — পুকুর খনন, বিধবা ভাতা, বেকার ভাতা — সবেতেই একই কাটমানি চক্র।


৬.

একদিন সকালেই গ্রামে খবর এল — সুধাংশুবাবুকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

স্থানীয়রা কিছুটা হতবাক, কিছুটা স্বস্তিতে। কিন্তু গল্প এখানেই থামে না।

কারণ কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সময় সেবা কেন্দ্র নতুন রঙে আবার খুলে গেল — এবার নাম "জনকণ্ঠ সেবাশ্রী সংঘ"। নেতৃত্বে এবার সুধাংশুবাবুর শ্যালক।

তৃষা দে বুঝলেন, শুধু একজনকে ধরা গেলেই কিছু বদলায় না। যতক্ষণ না মানুষের মধ্যে সচেতনতা আসে, যতক্ষণ না তারা প্রকৃত শিক্ষা পায় — ততদিন সমাজসেবা শুধুই একটি মুখোশ হয়ে থাকবে।


৭.

তৃষা দে এবার নতুন এক উদ্যোগ শুরু করলেন — “সত্যের পাঠশালা”। তিনি গ্রামের ছেলে-মেয়েদের নিজের হাতে পড়াতে শুরু করলেন। শেখালেন, কীভাবে প্রকল্প চেনা যায়, কিভাবে সরকারি স্কিমে আবেদন করা যায় নিজেরা — কোন ফর্ম কিভাবে পূরণ করতে হয়, তা শেখালেন।

ধীরে ধীরে গ্রামের মানুষ সময় সেবার মুখোশ চিনতে শিখলো।

গল্পের শেষে গ্রামটা একটু বদলে যায়। শুধু সরকার ভরসা করে নয় — নিজেরা চেষ্টা করেই ছোট ছোট পরিবর্তনের দিকে হাঁটতে শুরু করে।


📘 উপসংহার:

"সময় সেবা" যেন না হয় সময়ের ব্যবসা। যখনই সমাজসেবার নামে ব্যক্তি বা দল রাজনৈতিক সুবিধা লুটতে শুরু করে — তখনই সে সেবা দুর্নীতির ডালপালা গজায়। এ গল্প শুধুই রাণীবাঁধের নয় — এ তো গোটা ভারতের গল্প।



গল্পটি ভালো লাগলে নিচে অবশ্যই কমেন্ট করে জানান। 




*নয়ন তারা*

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

প্রাক্তন স্যারের শ্রেণিকক্ষ

ছায়া থেকে আলো

ডি এ পাওয়ার অপেক্ষা