অভিশপ্ত মানবতা
গল্পের নাম: “অভিশপ্ত মানবতা”
বর্ষাকাল। পশ্চিম মেদিনীপুরের আকাশ যেন দিনের পর দিন কাঁদছে। মেঘে ঢাকা রাত, টিপটিপ বৃষ্টি। গড়বেতার বাজার থেকে ব্যবসায়ী অরিন্দম ঘোষ তাঁর দিনের শেষ লেনদেন সেরে একটা পুরোনো হাতব্যাগে দু’লাখ টাকা নিয়ে মোটরসাইকেল চালিয়ে ফিরছিলেন চন্দ্রকোনার দিকে। তাঁর মাথায় শুধু হিসেব আর আগামীকালের অর্ডারের চিন্তা।
রাত তখন প্রায় সাড়ে দশটা। সারসার পোলের কাছে এসে অরিন্দমের বাইক আচমকাই ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে যায়। সামনে দাঁড়িয়ে এক মহিলা—লম্বা চুল, লাল শাড়ি, বৃষ্টিতে ভেজা মুখ যেন জোনাকির আলোয় ঝলমল করছে।
“দাদা, একটু উঠিয়ে দিন… আমার গন্তব্য খুব কাছে… বৃষ্টি-আঁধারে কোনো গাড়ি থামছেই না।”
অরিন্দম দ্বিধায় পড়লেও, কণ্ঠে ছিল এক অদ্ভুত আকর্ষণ। তিনি হালকা হেসে বললেন, “চলেন, চেপে বসুন।”
কিন্তু বাইক চালাতে চালাতে হঠাৎই অরিন্দমের চেতনা ভোঁতা হতে থাকে। চারদিক ঝাপসা। ঘোরের মধ্যে মনে হয়, তিনি কোনও অন্ধকার ঘরে পড়ে আছেন। সামনে সেই নারী—তবে এবার তিনি একেবারে অন্যরূপে। মুখে রহস্যময় হাসি। চোখে যেন হাজার বছরের গ্লানি, কিন্তু তাতে লুকিয়ে আছে এক অভিশপ্ত মোহ।
“তোমার টাকা আমি নিয়ে নিচ্ছি,” মহিলা বললেন ঠান্ডা কণ্ঠে। “কিন্তু ভয় পেয়ো না, আমি কেবল তাদের কাছ থেকেই নিই, যারা অহংকারে ভরে থাকে।”
পরদিন ভোরে, সার সার পোলের পাশের এক জঙ্গলের মধ্যে অরিন্দমকে উদ্ধার করে স্থানীয় লোকেরা। তাঁর ব্যাগ খালি। পুলিশ রিপোর্টে লেখা হয় – ডাকাতি।
কিন্তু এখানেই গল্প শেষ হয় না।
কয়েকদিন পর, স্থানীয় পত্রিকায় খবর ছাপা হয় – “সুমিত্রা দেবী” নামে এক সমাজসেবিকা গরীব শিশুদের জন্য নতুন বিদ্যালয় খুলেছেন। বিদ্যালয়টি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত অর্থানুকুল্যে। তার উদ্যোগে অন্ধ শিশুদের জন্যও বিশেষ শিবির চলছে।
ছবিতে সেই মুখ, যাকে অরিন্দম স্বপ্ন না বাস্তব—তা বুঝে উঠতে পারেননি।
তাঁর ব্যবসায় অদ্ভুতভাবে ধস নামে। একের পর এক ডিল বাতিল হয়। বন্ধুরা মুখ ফিরিয়ে নেয়। একসময় তিনি উপলব্ধি করেন—অহংকারে মোড়া তাঁর ব্যবসা ছিল শুধুই আত্মসন্তুষ্টির পুতুলখেলা।
বছর ঘুরে আবার বর্ষা আসে।
এইবার, সার সার পোলের সামনে দাঁড়িয়ে এক ভিজে মহিলা—একজন নতুন ব্যবসায়ীর বাইক থামায়।
কেবল একটিই প্রশ্ন থেকে যায়—
সুমিত্রা কি সত্যিই মানুষ? নাকি এক অভিশাপ, যিনি সমাজসেবার মুখোশে অহংকারী মানুষদের শিক্ষা দেন, আবার গড়েও তোলেন ভাঙা সমাজ?
*নয়ন তারা*
Comments
Post a Comment